লেবেল

নিজেকে এখনও গুছিয়ে নিতে পারিনি

২৭ এপ্রিল, ২০১১

বইপড়ার অভিজ্ঞতা..!!

ছোট বেলায় পড়েছিলাম বই কিনে নাকি কেউ দেওলিয়া হয় না । বর্তমান যুগে এই কথাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে । কিন্তু এটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে বই পড়ে কেউ দেওলিয়া হয় না । আমি বিশ্বাস করি একমাত্র বই পড়লেই প্রাচুর্য লাভ করা যায় । জ্ঞানের প্রাচুর্য । যা কখনও কমেনা , বরং বেড়েই যায় । কারণ বইই একমাত্র মাধ্যম যেখানে সঞ্চিত আছে হাজারো মানুষের অর্জিত জ্ঞান । আর সেই বই পড়া মানেই তার অর্জিত জ্ঞান নিজের মধ্যেও নিয়ে নেওয়া । শতাব্দী প্রাচীনকাল থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে কাগজ থেকে বই আজ ইবুকে রূপ নিয়েছে ।


খুব ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোন বই পড়তাম না । ছোটবেলার সেই ধারাপাত বই পড়তেই অনেক কষ্ট হত আর ভাবতাম কখন পড়া শেষ করে খেলতে যাব । ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলিতে ঝোলেনি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে । ছেলে বুড়ো সকলের কাছে এখন পর্যন্ত সমান জনপ্রিয় ঠাকুমার ঝুলি । আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশিবার পঠিত বই ঠাকুমার ঝুলি । রাক্ষোস ক্ষোকসের সাথে রাজকন্যা আর রাজপুত্রের প্যাচগোচ বুঝতে বুঝতে ঘুমাতে হত তখন । ঠাকুমার ঝুলি মানুষ নাকি দাদী নানীর কাছেই প্রথম শুনে থাকে । কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি প্রথম গল্প শুনি আমার বড় আপুর কাছে । ঠাকুমার সাথে আপু প্রাইজ হিসেবে পাওয়া বিভিন্ন দেশের রূপকথার গল্প বইটাও পড়ে শোনাত । আমার পেছনে আমার বড় আপুর অবদান কখনই ভুলতে পারব না ।


যাই হোক এরপর কিছুটা বড় হয়ে কমিকস পড়া শুরু করলাম । ক্লাশ থ্রিতে পড়ার সময় হাতে এল প্রাণের কমিকস..!! প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কমিকস কিনতাম । আম্মুর সাথে আমার ডিলই ছিল প্রতিদিন আমাকে কমিকস কিনে দেয়া । আর সেই সব বই বন্ধুরা শেয়ার করতাম । চাচা চৌধুরী , বিল্লু , পিঙ্কি , রমণ , ডায়নামাইট , ফ্যান্টম , লম্বু মোটু , প্রাণের সব বইই পড়াতাম । তবে এর মধ্যেও সবচেয়ে প্রিয় ছিল অবশ্যই চাচা চৌধুরী । সাবু আর কুকুর রকেটকে নিয়ে চাচা চৌধুরীর সেই কাহিনীগুলা আজও ভুলতে পারিনি । আর ভুলতে পারিনি ব্যাক ডায়ালগ...চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের চেয়ে প্রখর...!!!


আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম । কিন্তু বই পড়ার দিক থেকে আর বড় হতে পারছিনা । ছোট গল্প আর কমিকসের বাইরে অন্য কিছুই ভাল লাগেনা । ততদিনে আপুরা দেখতাম মাঝারি সাইজের কিছুটা মোটা তিন গোয়েন্দা নামে কি বই যেন পড়ত । অনেক চেষ্টা করেছি । কিন্তু ভাল লাগাতে পারিনি । আমার বন্ধুরাও ততদিনে তিন গোয়েন্দা পড়া শুরু করে দিয়েছে । কিন্তু আমি পড়তেই পারছিনা । কষ্ট লাগে এত বড় বই পড়তে..!!! ওই সময়ে বিমান দূর্ঘটনা বইটা যে কতবার শুরু করেছি তার ইয়াত্তা নেই । কিন্তু শেষ করতে পারিনি । অবশেষে ক্লাশ সেভেনে আমার বন্ধু রিফাত আমাকে এক রকম জোর করেই একটা তিন গোয়েন্দা বই পড়তে দিল । অনেক অনুরোধ করে বলল শুধু একটা বই যেন আমি পড়ি । এরপর ভাল না লাগলে আর পড়ার দরকার নেই । আমার এখনও মনে আছে রিফাতের দেয়া আমার পড়া তিন গোয়েন্দার প্রথম বইটির কথা । বইটি ছিল জলদস্যুর মোহর নামে একটা বই । ওই বইতে তিন গোয়েন্দার চিরশুত্রু শুঁটকি টেরিও ছিল । স্কুল থেকে এসে ড্রেস চেঞ্জ না করেই বিছানায় শুয়ে পড়া শুরু করেছিলাম বইটি । আমার এখনও মনে আছে সারাদিন লেগেছিল বইটা শেষ করতে । বইটা শেষ করে মনে হয়েছিল আমি যেন অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছি । ওই বয়সে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় প্রতিটি কিশোর কিশোরীর কাছে তিন গোয়েন্দা ছিল রীতিমত হিরো । সবাই আচ্ছন্ন ছিল তিন গোয়েন্দার লাইফের প্রতি । আমিও তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না । বাংলাদেশে তিন গোয়েন্দা পড়েনি এমন শিক্ষিত কিশোর কিশোরী মনে হয় কমই আছে । আমার মনে হয় তিন গোয়েন্দা পড়ার পর থেকেই আমি কিছুটা আধুনিক হয়েছি, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে জানতে পেরেছি । তাই তিন গোয়েন্দার কাছে আমি আজীবন ঋণী হয়ে রইলাম ।


এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার আগ পর্যন্ত শুধু তিন গোয়েন্দাই পড়েছি । এর বাইরে সেবার কিছু অনুবাদ আর ওয়েস্টার্ণ পড়েছি । তবে তিন গোয়েন্দার মত আর কিছুই আমাকে টানতে পারেনি । অনেকেই তখন মাসুদ রানা পড়ত । কিন্তু মাসুদ রানা আমাকে কখনও টানতে পারেনি । কারণটা আমি নিজেও জানিনা । তখন পর্যন্ত যে কোন ধরণের উপন্যাস আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল । কিন্তু আমি ওই সময় ফুপির বাসায় গিয়ে তসলিমা নাসরিনের নিষিদ্ধ উতল হাওয়া বইটি লুকিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম..!! হা হা হা । যদিও আইনটা আমার ছোট বোনের ক্ষেত্রে ছিল না । ও ক্লাশ সেভেন থেকেই হুমায়ূন, মিলন পড়ত । দুইজনের জন্য কেন দুইটি ভিন্ন আইন বলবৎ ছিল আমি জানিনা । বড় আপু ছিল এই আইনের প্রবক্তা । তবে অবশ্য পাঠ্যের তালিকায় হাজার বছর ধরে ছিল বলে ওই কার্ফিউর সময় উপন্যাসটা পড়েছিলাম । আমার সর্বাধিক পঠিত বইয়ের তালিকায় হাজার বছর ধরে বইটি বেশ উপরের দিকেই থাকবে । মন্তু আর টুনির কৈশোরিক প্রেম কাহিনী সেই কিশোর বয়সে আমার মনে অনেক দোলা দিয়েছিল..!!


কলেজে উঠেই আমার যে কথা প্রথম মনে হয়েছে সেটা হল আমি এখন অনেক বড় । তাই সবকিছুই পড়ার বয়স আমার হয়েছে । কিন্তু হায় যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় । সাতকাহন বইটা নিয়ে প্রথমেই ধরা খেলাম আপুর হাতে । যথারিতী জানলাম কার্ফিউ বলবৎ আছে । সুনীল সমরেশ পড়ার বয়স হয়নি । অগ্যতা হুমায়ূন আর জাফর ইকবালই ভরসা । কলেজের দুই বছর চুটিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবালের বই পড়েছি । জাফর ইকবালের বই আগেও পড়েছি, কিন্তু সত্যিকারের মজা পাইছি এই দুই বছরে । ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর সদস্য ছিলাম, সেই সাথে বাসার সংগ্রহ নেহাত কম ছিল না । তাই বইয়ের অভাব হয়নি । দুই ভাইয়ের সব লেখাই গোগ্রাসে গিলতাম । হিমু পড়ে উদাস হতাম, তো মিসির আলী পড়ে আবার বিচক্ষণ ব্যাক্তি, তার মাধ্যমেই ট্রেনে করে ঘুরে এসেছি দারূচিনি দ্বীপ আর কলম্ব । মনে আছে জাফর ইকবালের আমি তপু পড়ে চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । খুব ইচ্ছে করত দুষ্ট ছেলেদের দলের সাথে মিশে যেতে, দীপু নাম্বার টুর মত প্রাচীন গুহায় গুপ্তধন খুজতে, হাত কাটা রবিনের মত বন্ধু পেতে । আর আমার বন্ধু রাশেদ পড়ে শিখেছি রাজাকার হায়েনাদের ঘৃণা করতে , দেশকে ভালবাসতে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে ।


এতসব ছাড়া আহসান হাবীব, আব্দুল্লাহ আবু সাইদ স্যার , নিমাই ভট্টাচার্য, জীবনানন্দ দাসের লেখাও পড়েছি । ভালবাসা কি জিনিস তা নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব পড়েই প্রথম বুঝেছি । পাঠ্য বইয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কিছু বই পড়েছি । কিন্তু শ্রীকান্ত আর দেবদাস ছাড়া শরৎ রচনাবলী পড়া হয়নি । যুগের হাওয়ায় হ্যারি পটার, দ্য দ্যা ভিঞ্চি কোড পড়তে হয়েছে । পটার সিরিজ আমার কাছে তিন গোয়েন্দার মতই প্রিয় । এছড়াও ইমদাদুল হক মিলন, প্রণব ভট্ট আর আনিসুল হকের কিছু বই পড়া হয়েছে । শেষ পড়েছি সৈয়দা ফারজানা সুলতানার জলে ভেজা মন । কিন্তু পড়া হয়নি সুনীল সমরেশ...!!! এই ইউনিভার্সিটি জীবনে প্রবেশ করেও আপুর কাছে শুনতে হয় " আগে বড় হও তারপর সুনীল সমরেশ পড়বা..!!" আমিও আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনা । আগ্রহও হারিয়ে ফেলছি সুনীল সমরেশের প্রতি । ও আমার ছোট বোনের কিন্তু সমরেশের প্রধান বইগুলা পড়া শেষ..!!


আজ যখন ফেলে আসা জীবনের পাতা উল্টাই তখন মনে হয় কম বই পড়িনি । তখন হিসেব করতে বসে যাই কি শিখলাম আমি । ভেবে কোন কূল পাইনা । ছোট্ট একটা অনুভূতি বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে । জ্ঞানের মহাসমুদ্রে এ আমার ক্ষুদ্র পদচিহ্ন মাত্র ।


ভাল থাকুন । ধন্যবাদ

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | coupon codes